আমমোক্তারনামা দলিল: প্রকারভেদ ও ব্যবহারের নিয়ম

অনেক সময় বিভিন্ন কারণে সম্পত্তির মালিকের পক্ষে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থেকে জমিজমা সংক্রান্ত কাজ, যেমন—বিক্রি, রক্ষণাবেক্ষণ বা মামলা পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য এটি একটি বড় সমস্যা। এই ধরনের পরিস্থিতিতে যে আইনি দলিলের মাধ্যমে এক ব্যক্তি তার পক্ষে কাজ করার জন্য অন্য কোনো ব্যক্তিকে ক্ষমতা অর্পণ করেন, তাকে আমমোক্তারনামা বা Power of Attorney (PoA) বলা হয়।

এই আর্টিকেলে আমরা আমমোক্তারনামা দলিলের প্রকারভেদ, ব্যবহারের নিয়ম, রেজিস্ট্রি প্রক্রিয়া এবং এর ঝুঁকি ও সতর্কতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

ammoktarnama dolil ki

আমমোক্তারনামা (Power of Attorney) কি?

আমমোক্তারনামা এমন একটি আইনগত দলিল, যার মাধ্যমে দলিলের দাতা (Principal) তার নিজের পক্ষে কোনো কাজ সম্পাদন করার জন্য অন্য কোনো ব্যক্তিকে (Agent/Attorney) ক্ষমতা প্রদান করেন। যার অনুকূলে ক্ষমতা দেওয়া হয়, তিনি দাতার প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন এবং তার কৃতকাজ দাতার নিজের দ্বারাই কৃত বলে গণ্য হয়।

জেনে নিনঃ জমির দলিল কি?

আমমোক্তারনামা দলিলের প্রকারভেদ

কাজের পরিধি ও উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে আমমোক্তারনামা প্রধানত দুই প্রকারের হয়:

১. সাধারণ আমমোক্তারনামা (General Power of Attorney – GPA) এই দলিলের মাধ্যমে দাতা তার প্রতিনিধিকে একাধিক বা ব্যাপক ক্ষমতা প্রদান করেন। যেমন—কোনো একটি সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ করা, ভাড়া আদায় করা, মামলা পরিচালনা করা ইত্যাদি বিভিন্ন কাজ করার জন্য সাধারণ আমমোক্তারনামা দেওয়া হতে পারে।

গুরুত্বপূর্ণ: স্থাবর সম্পত্তি (জমি/ফ্ল্যাট) বিক্রির উদ্দেশ্যে সাধারণ আমমোক্তারনামা প্রদান করা যায় না।

২. বিশেষ আমমোক্তারনামা (Special Power of Attorney – SPA) যখন কোনো একটি বা কয়েকটি নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদনের জন্য ক্ষমতা দেওয়া হয়, তখন তাকে বিশেষ আমমোক্তারনামা বলে। যেমন—শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট জমি বিক্রি করার জন্য, অথবা শুধুমাত্র একটি মামলা পরিচালনা করার জন্য এই দলিল তৈরি করা হয়। কাজটি সম্পন্ন হয়ে গেলে এই দলিলের কার্যকারিতা সাধারণত শেষ হয়ে যায়।

স্থাবর সম্পত্তি বিক্রির জন্য অবশ্যই বিশেষ আমমোক্তারনামা সম্পাদন করতে হবে।

কখন আমমোক্তারনামা প্রয়োজন হয়?

  • সম্পত্তির মালিক বিদেশে অবস্থান করলে।
  • মালিক অসুস্থতা বা বার্ধক্যজনিত কারণে কাজ করতে অক্ষম হলে।
  • একাধিক মালিকের পক্ষে একজন কাজ করার প্রয়োজন হলে।
  • আইনি বা দাপ্তরিক প্রক্রিয়া সম্পাদনের জন্য।

আমমোক্তারনামা রেজিস্ট্রি ও আইনগত প্রক্রিয়া

  • রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক: পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি আইন, ২০১২ অনুযায়ী, আমমোক্তারনামা দলিল অবশ্যই রেজিস্ট্রি করতে হবে। রেজিস্ট্রি ছাড়া এর কোনো আইনগত মূল্য নেই।
  • ছবি ও আঙুলের ছাপ: দাতা ও গ্রহীতা উভয়ের ছবি ও আঙুলের ছাপ দলিলে যুক্ত করতে হয়।
  • বিদেশ থেকে আমমোক্তারনামা: যদি দাতা বিদেশে অবস্থান করেন, তবে সেই দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের কনস্যুলার অফিসারের মাধ্যমে দলিলটি প্রত্যয়িত করে পাঠাতে হবে। এরপর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয় থেকে স্ট্যাম্পিং ও অনুমোদনের পর বাংলাদেশে রেজিস্ট্রি করতে হয়।

আমমোক্তারনামা বাতিলের প্রক্রিয়া

দাতা চাইলে যেকোনো সময় তার দেওয়া আমমোক্তারনামা বাতিল করতে পারেন। এর জন্য তাকে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে একটি “আমমোক্তারনামা প্রত্যাহার” (Revocation of Power of Attorney) দলিল রেজিস্ট্রি করতে হবে। এছাড়া, দাতা বা গ্রহীতার মৃত্যু হলে অথবা চুক্তির উদ্দেশ্য সফল হলে আমমোক্তারনামা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যায়।

ঝুঁকি ও সতর্কতা

আমমোক্তারনামা একটি অত্যন্ত শক্তিশালী দলিল, যা অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। তাই:

  • শুধুমাত্র অত্যন্ত বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে আমমোক্তার নিয়োগ করুন।
  • কাজের পরিধি দলিলে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে দিন। অপ্রয়োজনীয় কোনো ক্ষমতা প্রদান করবেন না।
  • বিশেষ করে সম্পত্তি বিক্রির ক্ষমতা দেওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক থাকুন।
  • সম্ভব হলে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা (যেমন: ৬ মাস বা ১ বছর) উল্লেখ করে দিন।

সাধারণ জিজ্ঞাসাসমূহ (FAQs)

১. আমমোক্তার কি নিজের নামে সম্পত্তি রেজিস্ট্রি করতে পারে?

উত্তরঃ না, আমমোক্তার একজন প্রতিনিধি মাত্র। তিনি দাতার নামেই সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তর করবেন। তিনি নিজের নামে সেই সম্পত্তি রেজিস্ট্রি করতে পারেন না।

২. বাবা কি ছেলের নামে আমমোক্তারনামা দিতে পারেন?

উত্তরঃ হ্যাঁ, যেকোনো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি অন্য যেকোনো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে (আত্মীয় বা অনাত্মীয়) আমমোক্তার নিয়োগ করতে পারেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top