বণ্টননামা দলিল: শরিকদের মধ্যে সম্পত্তি ভাগ করার আইনি প্রক্রিয়া

উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বা একাধিক ব্যক্তির যৌথ মালিকানায় থাকা সম্পত্তিকে এজমালি বা শরিকানা সম্পত্তি বলা হয়। এই ধরনের সম্পত্তির উপর প্রত্যেক সহ-মালিক বা শরিকের অংশ থাকলেও, কে কোন অংশ ভোগ-দখল করবে তা নির্দিষ্ট করা থাকে না। এই এজমালি সম্পত্তি প্রত্যেক শরিকের মধ্যে তাদের নিজ নিজ অংশ অনুযায়ী ভাগ করে নেওয়ার জন্য যে দলিলটি সম্পাদন করা হয়, তাকে বণ্টননামা দলিল (Partition Deed) বলে।

এই আর্টিকেলে আমরা বণ্টননামা দলিল কেন জরুরি, এটি সম্পাদনের প্রক্রিয়া এবং এর আইনগত গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করব।

bontonnama dolil ki

বণ্টননামা দলিল কেন প্রয়োজন?

  • মালিকানা নির্দিষ্ট করা: বণ্টননামা দলিলের মাধ্যমে প্রত্যেক শরিক তার প্রাপ্য সম্পত্তির অংশ আইনগতভাবে নির্দিষ্ট করে নিতে পারেন। এর ফলে কে কোন দাগের কতটুকু জমি বা ফ্ল্যাটের কোন অংশ পাবে তা নির্ধারিত হয়ে যায়।
  • বিরোধ নিষ্পত্তি: যৌথ মালিকানাধীন সম্পত্তি প্রায়শই পারিবারিক বিরোধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একটি রেজিস্ট্রিকৃত বণ্টননামা দলিল এই ধরনের বিরোধ মেটাতে এবং भविष्यতে সম্ভাব্য ঝামেলা এড়াতে সাহায্য করে।
  • বিক্রি বা হস্তান্তরে সুবিধা: আপনি যদি আপনার অংশের সম্পত্তি বিক্রি করতে চান বা ব্যাংক লোন নিতে চান, তবে আপনার অংশ নির্দিষ্ট করা থাকতে হবে। বণ্টননামা দলিল ছাড়া এটি করা প্রায় অসম্ভব।
  • নামজারি (Mutation) করা: বণ্টননামা দলিলের মাধ্যমেই আপনি আপনার নির্দিষ্ট অংশের জন্য আলাদা খতিয়ান বা নামজারি করতে পারবেন।

জেনে নিনঃ জমির দলিল কি?

বণ্টননামা দলিল সম্পাদনের পদ্ধতি

বণ্টননামা দলিল দুইভাবে সম্পাদন করা যায়:

১. আপস-বণ্টননামা (Amicable Partition) যখন সকল শরিক বা সহ-মালিকরা নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সম্পত্তি ভাগাভাগি করতে সম্মত হন, তখন তারা একটি আপস-বণ্টননামা দলিল সম্পাদন করতে পারেন।

  • প্রক্রিয়া:
    • সকল শরিক মিলে একজন সার্ভেয়ার বা আমিনের সাহায্যে সম্পত্তি পরিমাপ করে নিজ নিজ অংশের সীমানা নির্ধারণ করবেন।
    • একজন আইনজীবীর সাহায্যে বণ্টনের শর্তাবলী উল্লেখ করে একটি দলিল প্রস্তুত করা হবে।
    • সকল শরিক নির্ধারিত দিনে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে উপস্থিত হয়ে দলিলটি রেজিস্ট্রি করবেন।
    • এই পদ্ধতিটি তুলনামূলকভাবে সহজ, দ্রুত এবং কম ব্যয়বহুল।

২. আদালত কর্তৃক বণ্টন (Partition by Court) যদি শরিকদের মধ্যে সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে কোনো বিরোধ দেখা দেয় বা কেউ আপসে বণ্টন করতে রাজি না হন, তবে যেকোনো একজন শরিক আদালতে “বণ্টনের মামলা” (Partition Suit) করতে পারেন।

  • প্রক্রিয়া:
    • আদালত সকল পক্ষের বক্তব্য শুনে এবং জমির কাগজপত্র পরীক্ষা করে প্রত্যেক শরিকের অংশ নির্ধারণ করে একটি প্রাথমিক ডিক্রি প্রদান করেন।
    • পরে আদালতের নির্দেশে একজন অ্যাডভোকেট কমিশনার সরেজমিনে গিয়ে সম্পত্তি পরিমাপ করে প্রত্যেককে তাদের অংশ বুঝিয়ে দেন এবং একটি চূড়ান্ত ডিক্রি জারি করা হয়।
    • এই চূড়ান্ত ডিক্রির ভিত্তিতেই রেজিস্ট্রি অফিসে বণ্টননামা দলিল রেজিস্ট্রি করা হয়।
    • এটি একটি সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া।

বণ্টননামা দলিলের রেজিস্ট্রি খরচ

আপস-বণ্টননামা দলিলের রেজিস্ট্রি খরচ খুবই কম। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত একটি নামমাত্র স্ট্যাম্প শুল্ক ও ফি প্রদান করে এটি রেজিস্ট্রি করা যায়। তবে আদালত কর্তৃক বণ্টনের ক্ষেত্রে মামলার খরচ তুলনামূলকভাবে বেশি।

বণ্টননামা দলিলের পর করণীয়

বণ্টননামা দলিল রেজিস্ট্রি করাই শেষ কথা নয়। এরপর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হলো, আপনার নির্দিষ্ট অংশের জন্য নামজারি (Mutation) করে একটি পৃথক খতিয়ান তৈরি করা এবং হালনাগাদ ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করা। এটি না করলে আপনার মালিকানা সম্পূর্ণ সুরক্ষিত হবে না।

সাধারণ জিজ্ঞাসাসমূহ (FAQs)

১. শরিকদের কেউ মারা গেলে বণ্টননামা কীভাবে হবে?

উত্তরঃ যদি কোনো শরিক মারা যান, তবে তার আইনসম্মত উত্তরাধিকারীগণ (heirs) তার অংশে অংশীদার হবেন এবং বণ্টননামা দলিলে তাদের পক্ষ থেকে স্বাক্ষর করতে হবে।

২. এজমালি সম্পত্তিতে কি বাড়ি করা যায়?

উত্তরঃ সকল শরিকের সম্মতি ছাড়া এজমালি সম্পত্তিতে কোনো একজন শরিক একা বাড়ি বা কোনো স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ করতে পারেন না। এটি করার আগে বণ্টননামা করে নেওয়া আবশ্যক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top