আপনি কি ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করার কথা ভাবছেন? পরিবার বা সমাজের নানা জটিলতা এড়িয়ে আইনিভাবে সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিতে চান? তাহলে “কোর্ট ম্যারেজ” শব্দটি নিশ্চয়ই আপনার মাথায় এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশে কোর্ট ম্যারেজ নিয়ে রয়েছে নানা ভুল ধারণা ও অসম্পূর্ণ তথ্য। অনেকেই মনে করেন, কোর্টে গিয়ে সই করলেই বিয়ে হয়ে যায়। বাস্তবতা কিন্তু কিছুটা ভিন্ন।
২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে, কোর্ট ম্যারেজ করার সঠিক নিয়ম, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, সম্ভাব্য খরচ এবং সম্পূর্ণ আইনি প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি। এই আর্টিকেলটি আপনার জন্য একটি সম্পূর্ণ নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করবে। আমরা ধাপে ধাপে পুরো বিষয়টি আলোচনা করব, যাতে আপনি কোনো দ্বিধা বা প্রতারণার শিকার না হয়ে আপনার নতুন জীবন শুরু করতে পারেন।
কোর্ট ম্যারেজ আসলে কী? প্রচলিত ভুল ধারণা বনাম বাস্তবতা
আমাদের সমাজে “কোর্ট ম্যারেজ” বলতে যা বোঝানো হয়, আইনগতভাবে তার ভিত্তি কিছুটা ভিন্ন। অনেকেই ভাবেন, কোর্ট বা আদালতের বিচারক এই বিয়ে পড়িয়ে দেন। এটি একটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।
বাস্তবতা হলো: বাংলাদেশে কোনো আদালত বা ম্যাজিস্ট্রেট সরাসরি বিয়ে পড়ান না। “কোর্ট ম্যারেজ” বলতে মূলত বোঝানো হয়, প্রাপ্তবয়স্ক দুজন নারী-পুরুষ স্বেচ্ছায়, কোনো প্রকার চাপ ছাড়াই একে অপরকে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার জন্য নোটারি পাবলিক বা প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে একটি হলফনামায় (Affidavit) স্বাক্ষর করেন।
এই হলফনামাটি বিয়ের একটি আইনগত প্রমাণ বা ঘোষণা মাত্র, এটি সম্পূর্ণ বিয়ে নয়। এটি মূলত একটি সম্পূরক দলিল। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, প্রতিটি বিয়ে অবশ্যই নিজ নিজ ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী সম্পন্ন হতে হবে এবং তা সরকারিভাবে নিবন্ধন করতে হবে।
- মুসলিমদের জন্য: হলফনামা সম্পাদনের পর অবশ্যই কাজি অফিসে গিয়ে ইসলামিক শরিয়াহ মোতাবেক নিকাহ সম্পন্ন করতে হবে এবং কাবিননামা বা নিকাহনামা রেজিস্ট্রি করতে হবে। শুধুমাত্র কোর্টের হলফনামা মুসলিম বিয়ের জন্য যথেষ্ট নয়।
- হিন্দুদের জন্য: হিন্দু ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী পুরোহিতের মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন করতে হবে। বর্তমানে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন অনুযায়ী বিয়ে নিবন্ধন করার সুযোগও রয়েছে, যা भविष्यে আইনি সুরক্ষার জন্য জরুরি।
- অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ও আন্তঃধর্মীয় বিয়ের ক্ষেত্রে: এক্ষেত্রে বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২ (Special Marriage Act, 1872) প্রযোজ্য হবে। এর জন্য আলাদা প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়, যা আমরা পরবর্তীতে আলোচনা করব।
সুতরাং, মূল কথা হলো, কোর্ট ম্যারেজ বা হলফনামা আপনার বিয়ের ঘোষণাপত্র, কিন্তু বিয়ের চূড়ান্ত আইনি দলিল হলো মুসলিমদের জন্য “নিকাহনামা” এবং অন্যান্যদের জন্য প্রযোজ্য ক্ষেত্রে “বিবাহ নিবন্ধন সার্টিফিকেট”।
কেন কোর্ট ম্যারেজ করবেন? এর সুবিধা ও অসুবিধা
যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তার ভালো-মন্দ দিকগুলো জেনে নেওয়া উচিত। কোর্ট ম্যারেজের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়।
কোর্ট ম্যারেজের সুবিধা (Advantages)
- আইনি সুরক্ষা: এটি বিবাহের একটি শক্তিশালী প্রমাণপত্র। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক প্রমাণ, паспорте নাম পরিবর্তন, সন্তানের বৈধতা, সম্পত্তি উত্তরাধিকার এবং भविष्यে যেকোনো আইনি জটিলতায় এই হলফনামা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
- দ্রুত ও সহজ প্রক্রিয়া: প্রচলিত জাকজমকপূর্ণ বিয়ের তুলনায় এর প্রক্রিয়া অনেক সহজ ও কম সময়সাপেক্ষ।
- স্বেচ্ছায় বিয়ের প্রমাণ: যেহেতু এটি ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে করা হয়, তাই এটি প্রমাণ করে যে বিয়েটি কোনো প্রকার জোর বা চাপ ছাড়াই স্বেচ্ছায় সম্পন্ন হয়েছে।
- পরিবারের অমতে বিয়ের ক্ষেত্রে: অনেক সময় প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও পারিবারিক সম্মতির অভাবে বিয়ে করা কঠিন হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে কোর্ট ম্যারেজ একটি আইনি ভিত্তি প্রদান করে।
- খরচ কম: সামাজিক বিয়ের বিশাল খরচের তুলনায় কোর্ট ম্যারেজের খরচ তুলনামূলকভাবে অনেক কম।
- ভিসা প্রসেসিং ও বিদেশে গমনের জন্য: বিদেশে স্বামী বা স্ত্রীকে স্পন্সর করার জন্য বা ভিসা আবেদনের ক্ষেত্রে ম্যারেজ সার্টিফিকেট ও হলফনামা দুটোই খুব জরুরি।
অসুবিধা ও প্রচলিত ঝুঁকি (Disadvantages & Risks)
- সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা: অনেক পরিবার বা সমাজ এখনও কোর্ট ম্যারেজকে সহজভাবে গ্রহণ করে না, যা পারিবারিক দ্বন্দের কারণ হতে পারে।
- শুধুমাত্র হলফনামার উপর নির্ভরতা: সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো, অনেকে শুধু হলফনামা করেই মনে করেন বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেছে। পরবর্তীতে ধর্মীয় বা আইন অনুযায়ী বিয়ে নিবন্ধন না করায় মারাত্মক আইনি জটিলতা তৈরি হয়। স্ত্রী তার আইনগত অধিকার, যেমন- দেনমোহর বা ভরণপোষণ থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।
- প্রতারণার ঝুঁকি: অনেক সময় আদালতের আশেপাশে কিছু দালাল বা অসাধু ব্যক্তি কম খরচে কোর্ট ম্যারেজ করিয়ে দেওয়ার নামে প্রতারণা করে। তারা ভুয়া স্ট্যাম্প বা জাল সই ব্যবহার করে নকল দলিল তৈরি করে দেয়, যার কোনো আইনি ভিত্তি থাকে না।
- আইনি অসম্পূর্ণতা: মুসলিম বিয়ের ক্ষেত্রে কাবিননামা ছাড়া শুধু হলফনামার বলে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব। আইন অনুযায়ী, নিবন্ধনবিহীন মুসলিম বিয়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
কোর্ট ম্যারেজ করার আইনগত যোগ্যতা ও পূর্বশর্ত (২০২৫)
বাংলাদেশে কোর্ট ম্যারেজ বা যেকোনো ধরনের বিয়ে করার জন্য আইন দ্বারা নির্ধারিত কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। ২০২৫ সালেও এই শর্তগুলো অপরিবর্তিত থাকার সম্ভাবনা।
- পাত্রের বয়স (Groom’s Age): পাত্রের বয়স অবশ্যই ন্যূনতম ২১ বছর পূর্ণ হতে হবে।
- পাত্রীর বয়স (Bride’s Age): পাত্রীর বয়স অবশ্যই ন্যূনতম ১৮ বছর পূর্ণ হতে হবে।
- পারস্পরিক সম্মতি (Mutual Consent): বিয়েতে পাত্র-পাত্রী উভয়ের সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় সম্মতি থাকতে হবে। কোনো প্রকার ভয়-ভীতি, চাপ বা প্রতারণার মাধ্যমে সম্মতি আদায় করা হলে সেই বিয়ে অবৈধ বলে গণ্য হবে।
- সাক্ষীর উপস্থিতি (Presence of Witnesses): হলফনামা সম্পাদনের সময় কমপক্ষে দুজন সাক্ষী উপস্থিত থাকতে হবে। সাক্ষীদেরও প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে।
- আইনগত বাধা না থাকা (No Legal Impediments): পাত্র বা পাত্রী কারোরই পূর্ববর্তী কোনো বৈধ বিবাহ থাকা চলবে না। যদি কেউ পূর্বে বিবাহিত হয়ে থাকেন, তবে অবশ্যই পূর্ববর্তী বিয়ের আইনসম্মতভাবে পরিসমাপ্তি (যেমন- তালাক বা স্ত্রীর মৃত্যু) ঘটাতে হবে এবং তার স্বপক্ষে প্রমাণপত্র (তালাকনামা বা মৃত্যু সনদ) থাকতে হবে।
এই শর্তগুলোর যেকোনো একটি পূরণ না হলে বিয়েটি শিশু বিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
বিস্তারিতঃ কোর্ট ম্যারেজ কি আইনত বিয়ে?
প্রয়োজনীয় দলিলপত্র: কী কী লাগবে আপনার? (Checklist)
কোর্ট ম্যারেজের প্রক্রিয়া শুরু করার আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র প্রস্তুত রাখা আবশ্যক। এতে পুরো প্রক্রিয়াটি অনেক সহজ ও দ্রুত হয়। নিচে একটি চেকলিস্ট দেওয়া হলো:
- পাত্র ও পাত্রীর জাতীয় পরিচয়পত্র (NID Card): উভয়ের NID কার্ডের স্পষ্ট ফটোকপি আবশ্যক। NID কার্ড না থাকলে জন্ম নিবন্ধন সনদ (Birth Certificate) দিয়েও কাজ চালানো যায়, তবে NID থাকা উত্তম। এটি বয়স ও পরিচয় প্রমাণের প্রধান দলিল।
- পাত্র ও পাত্রীর পাসপোর্ট সাইজের ছবি: উভয়ের সাম্প্রতিক তোলা ২ থেকে ৪ কপি পাসপোর্ট সাইজের রঙিন ছবি লাগবে।
- সাক্ষীদের জাতীয় পরিচয়পত্র (NID Card): যে দুজন সাক্ষী থাকবেন, তাদের NID কার্ডের ফটোকপি এবং ক্ষেত্রবিশেষে ছবিও লাগতে পারে।
- বয়স প্রমাণের সনদ (Age Proof): NID বা জন্ম নিবন্ধন সনদ ছাড়াও বয়স প্রমাণের জন্য SSC বা সমমানের পরীক্ষার সার্টিফিকেট বা পাসপোর্টের ফটোকপি সহায়ক দলিল হিসেবে কাজ করে।
- পূর্ববর্তী বিয়ের প্রমাণপত্র (যদি প্রযোজ্য হয়): পাত্র বা পাত্রী যদি পূর্বে বিবাহিত হন, তাহলে:
- তালাকপ্রাপ্ত হলে: ডিভোর্স সার্টিফিকেট বা তালাকনামার নোটিশ ও রেজিস্ট্রেশনের অনুলিপি।
- বিধবা বা বিপত্নীক হলে: পূর্ববর্তী স্বামী/স্ত্রীর মৃত্যু সনদের (Death Certificate) অনুলিপি।
এই সকল কাগজপত্রের মূল কপি সাথে রাখা ভালো, যদিও সাধারণত ফটোকপিই জমা দিতে হয়।
কোর্ট ম্যারেজ করার সম্পূর্ণ আইনি প্রক্রিয়া
এখন আমরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশে এসেছি। কোর্ট ম্যারেজের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি নিচে ধাপে ধাপে বর্ণনা করা হলো।
ধাপ ১: একজন অভিজ্ঞ আইনজীবী নির্বাচন
এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। কোর্ট চত্বরে অনেক দালাল বা টাউট ঘুরে বেড়ায় যারা আপনাকে কম খরচের লোভ দেখিয়ে ভুল পথে চালিত করতে পারে। তাই সবসময় একজন নির্ভরযোগ্য ও অভিজ্ঞ আইনজীবীর (Advocate) শরণাপন্ন হোন। একজন ভালো আইনজীবী আপনাকে সঠিক পরামর্শ দেবেন এবং পুরো প্রক্রিয়াটি আইনসম্মতভাবে সম্পন্ন করতে সাহায্য করবেন।
ধাপ ২: হলফনামা (Affidavit) প্রস্তুত করা
আপনার আইনজীবী পাত্র-পাত্রীর সকল তথ্য নিয়ে একটি হলফনামা খসড়া প্রস্তুত করবেন। এই হলফনামাটি ২০০ বা ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে প্রিন্ট করা হয়। হলফনামায় সাধারণত নিচের বিষয়গুলো উল্লেখ থাকে:
- পাত্র-পাত্রী ও তাদের পিতা-মাতার নাম ও সম্পূর্ণ ঠিকানা।
- উভয়ের বয়স ও ধর্ম।
- পরিচয়পত্রের (NID/জন্ম সনদ) নম্বর।
- এই মর্মে ঘোষণা যে তারা প্রাপ্তবয়স্ক এবং স্বেচ্ছায় একে অপরকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
- তাদের মধ্যে আগে থেকে কোনো প্রকার স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছিল না এবং তারা আইনত বিয়ে করার যোগ্য।
- মুসলিম হলে দেনমোহরের পরিমাণ উল্লেখ করা যেতে পারে।
- সাক্ষীদের নাম ও ঠিকানা।
ধাপ ৩: নোটারি পাবলিকের সামনে স্বাক্ষর ও সত্যায়ন
প্রস্তুতকৃত হলফনামাটি নিয়ে আইনজীবী আপনাকে একজন নোটারি পাবলিকের (Notary Public) সামনে উপস্থিত করবেন। সেখানে পাত্র-পাত্রী এবং সাক্ষীগণ নোটারি পাবলিকের সামনে হলফনামায় স্বাক্ষর করবেন। নোটারি পাবলিক আপনাদের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে হলফনামাটি সত্যায়িত (Attested) করবেন এবং তার রেজিস্টার বইয়ে এর বিবরণ লিপিবদ্ধ করবেন।
ধাপ ৪: প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হলফনামা সম্পাদন (ঐচ্ছিক কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ)
আইনিভাবে হলফনামাটি আরও শক্তিশালী করার জন্য অনেক আইনজীবী এটিকে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সম্পাদন করার পরামর্শ দেন। এক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট পাত্র-পাত্রীকে জিজ্ঞেস করতে পারেন যে তারা স্বেচ্ছায় বিয়ে করছেন কিনা। সম্মতি পেলে তিনি হলফনামায় স্বাক্ষর করে এটিকে আইনগত ভিত্তি প্রদান করেন। যদিও এটি বাধ্যতামূলক নয়, তবে भविष्यে আইনি সুরক্ষার জন্য এটি খুবই কার্যকর।
ধাপ ৫: বিয়ে নিবন্ধন (সবচেয়ে জরুরি ধাপ)
আগেই বলা হয়েছে, হলফনামা বিয়ের চূড়ান্ত দলিল নয়। এটি সম্পন্ন করার পর আপনাকে অবশ্যই বিয়ে নিবন্ধন করতে হবে।
- মুসলিম দম্পতিদের জন্য: হলফনামা করার পর যত দ্রুত সম্ভব একজন সরকার কর্তৃক লাইসেন্সপ্রাপ্ত কাজি বা নিকাহ রেজিস্ট্রারের কাছে যেতে হবে। সেখানে ইসলামিক শরিয়াহ অনুযায়ী সাক্ষীদের উপস্থিতিতে কলেমা পড়ে নিকাহ সম্পন্ন করতে হবে। কাজি সাহেব সরকারের নির্ধারিত ফরমে কাবিননামা বা নিকাহনামা প্রস্তুত করবেন এবং তা রেজিস্ট্রি বইয়ে লিপিবদ্ধ করবেন। এই কাবিননামাই আপনার বিয়ের প্রধান ও চূড়ান্ত আইনি দলিল।
- হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য: নিজ নিজ ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী বিয়ে সম্পন্ন করুন। হিন্দু দম্পতিরা চাইলে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন, ২০১২ অনুযায়ী তাদের বিয়ে নিবন্ধন করতে পারেন। এটি বাধ্যতামূলক না হলেও, भविष्यে প্রমাণ হিসেবে কাজ করে।
- আন্তঃধর্মীয় বিয়ের জন্য (Special Marriage Act, 1872): যদি পাত্র-পাত্রী ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হন অথবা কোনো ধর্মে বিশ্বাস না করেন, তবে তাদের বিয়ে বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২ এর অধীনে সম্পন্ন হবে। এর প্রক্রিয়াটি কিছুটা ভিন্ন:
- এই আইনের অধীনে নিযুক্ত ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাছে নির্দিষ্ট ফর্মে ছবিসহ আবেদন করতে হবে।
- রেজিস্ট্রার একটি নোটিশ জারি করবেন এবং এই নোটিশের একটি কপি তার অফিসের প্রকাশ্য স্থানে ১৪ দিনের জন্য ঝুলিয়ে রাখবেন।
- এই ১৪ দিনের মধ্যে যদি আইনগতভাবে বৈধ কোনো আপত্তি না আসে, তাহলে রেজিস্ট্রার পাত্র-পাত্রী ও তিনজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করবেন এবং একটি ম্যারেজ সার্টিফিকেট প্রদান করবেন।
কোর্ট ম্যারেজ খরচ ২০২৫: একটি সম্ভাব্য হিসাব
কোর্ট ম্যারেজের খরচ বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে, যেমন – আইনজীবীর ফি, শহরের অবস্থান, এবং প্রক্রিয়ার জটিলতা। নিচে ২০২৫ সালের জন্য একটি সম্ভাব্য খরচের ধারণা দেওয়া হলো:
খরচের খাত | সম্ভাব্য পরিমাণ (বাংলাদেশি টাকায়) | মন্তব্য |
আইনজীবীর ফি | ৳ ৫,০০০ – ৳ ১৫,০০০ | এটি আইনজীবীর অভিজ্ঞতা ও চেম্বারের উপর নির্ভর করে কম বা বেশি হতে পারে। |
নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প | ৳ ৩০০ – ৳ ৫০০ | সাধারণত ৩০০ টাকার স্ট্যাম্প ব্যবহার করা হয়। |
নোটারি পাবলিকের ফি | ৳ ৫০০ – ৳ ১,০০০ | নোটারি পাবলিক কর্তৃক সত্যায়নের জন্য এই ফি নেওয়া হয়। |
কোর্ট ফি/এফিডেভিট | ৳ ২০০ – ৳ ৫০০ | |
কাজি বা নিকাহ রেজিস্ট্রারের ফি | ৳ ১,০০০ – ৳ ৩,০০০+ | এটি দেনমোহরের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয় ( প্রতি হাজারে ৳১২.৫০)। |
বিশেষ বিবাহ রেজিস্ট্রারের ফি | ৳ ১,০০০ – ৳ ২,০০০ | এটি আন্তঃধর্মীয় বিয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। |
অন্যান্য খরচ (ফটোকপি, যাতায়াত) | ৳ ৫০০ – ৳ ১,০০০ | |
মোট সম্ভাব্য খরচ | ৳ ৮,০০০ – ৳ ২৫,০০০ | এটি একটি আনুমানিক হিসাব। স্থান ও পরিস্থিতি ভেদে খরচ পরিবর্তনশীল। |
সতর্কতা: কোনো দালাল যদি এর চেয়ে অনেক কম খরচে (যেমন ২-৩ হাজার টাকায়) কোর্ট ম্যারেজ করিয়ে দেওয়ার কথা বলে, তবে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সঠিক আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে উল্লিখিত খরচের কাছাকাছি একটি বাজেট রাখা বুদ্ধিমানের কাজ।
কোর্ট ম্যারেজ পরবর্তী করণীয়
বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে যা আপনার বিয়েকে সুরক্ষিত করবে।
- দলিলপত্র সংরক্ষণ: হলফনামা এবং ম্যারেজ সার্টিফিকেটের (নিকাহনামা) মূল কপি ও একাধিক ফটোকপি যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করুন।
- পরিবারকে জানানো: যত দ্রুত সম্ভব নিজেদের পরিবারকে বিয়ের বিষয়টি জানান। এতে প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু সমস্যা হলেও দীর্ঘমেয়াদে তা সমাধানের পথ খুলে দেয়।
- থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি): যদি কোনো পক্ষ থেকে হুমকি বা হয়রানির আশঙ্কা থাকে, তবে নিকটস্থ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ। এতে আইনি সুরক্ষা পাওয়া সহজ হয়।
- আইনি কাগজপত্র আপডেট: প্রয়োজন হলে паспоর্ট, NID কার্ড এবং অন্যান্য দলিলে স্বামী/স্ত্রীর নাম সংযোজন বা ঠিকানা পরিবর্তন করে নিন।
সাধারণ প্রশ্নাবলী (FAQ)
প্রশ্ন ১: বাবা-মায়ের অনুমতি ছাড়া কোর্ট ম্যারেজ করা যায় কি?
উত্তর: হ্যাঁ, বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী পাত্রের বয়স ২১ এবং পাত্রীর বয়স ১৮ পূর্ণ হলে তারা অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই স্বেচ্ছায় বিয়ে করতে পারেন। এটি আইনত বৈধ।
প্রশ্ন ২: শুধু হলফনামা দিয়ে কি বিয়ে সম্পন্ন হয়?
উত্তর: না, স্পষ্টভাবে মনে রাখবেন, শুধুমাত্র হলফনামা বিয়ে নয়। এটি বিয়ের একটি ঘোষণাপত্র মাত্র। মুসলিমদের জন্য নিকাহনামা এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অন্যদের জন্য ম্যারেজ সার্টিফিকেট থাকা বাধ্যতামূলক।
প্রশ্ন ৩: কোর্ট ম্যারেজ সার্টিফিকেট পেতে কতদিন সময় লাগে?
উত্তর: হলফনামা ও নোটারির কাজ সাধারণত ১ দিনেই সম্পন্ন হয়ে যায়। মুসলিম বিয়ের ক্ষেত্রে কাজি অফিসেও ১ দিনেই নিকাহ রেজিস্ট্রি করা সম্ভব। তবে বিশেষ বিবাহ আইনের অধীনে বিয়েতে নোটিশ পিরিয়ডের জন্য কমপক্ষে ১৪ দিন সময় লাগে।
প্রশ্ন ৪: বিদেশি নাগরিককে বিয়ে করার নিয়ম কী?
উত্তর: একজন বাংলাদেশি নাগরিক বিদেশি নাগরিককে বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২ এর অধীনে বিয়ে করতে পারেন। এক্ষেত্রে বিদেশির পাসপোর্ট, ভিসা এবং তার দেশের “No Objection Certificate” (NOC) বা বৈবাহিক অবস্থা প্রমাণের সনদপত্র প্রয়োজন হবে।
শেষ কথা
কোর্ট ম্যারেজ দুটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের একসঙ্গে পথচলার একটি আইনি ভিত্তি তৈরি করে দেয়। তবে এই পথটি মসৃণ রাখতে হলে সঠিক তথ্য জানা এবং আইনসম্মতভাবে প্রতিটি ধাপ সম্পন্ন করা অত্যন্ত জরুরি। অসম্পূর্ণ জ্ঞান বা দালালের খপ্পরে পড়ে আপনার জীবনের столь গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্তকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবেন না।
সবসময় একজন ভালো আইনজীবীর পরামর্শ নিন, প্রতিটি দলিল মনোযোগ দিয়ে পড়ুন এবং বিয়ের মূল ভিত্তি যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভালোবাসা, তা অটুট রাখুন। আইন আপনাকে সুরক্ষা দেবে, কিন্তু সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব আপনাদেরই।
আপনারা কি কোর্ট ম্যারেজ নিয়ে কোনো দ্বিধায় আছেন? অথবা আপনার কোনো অভিজ্ঞতা কি আমাদের সাথে শেয়ার করতে চান? নিচে কমেন্ট বক্সে আপনার প্রশ্ন বা মতামত জানান। এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন যারা বিয়ের পরিকল্পনা করছেন, যাতে তারাও সঠিক পথে অগ্রসর হতে পারে।