মুসলিম আইনে হেবা বা দান একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এর মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি কোনো প্রকার বিনিময় মূল্য ছাড়া তার সম্পত্তি অন্য কোনো ব্যক্তিকে হস্তান্তর করতে পারেন। সাধারণত, রক্তের সম্পর্কের নিকটাত্মীয়দের মধ্যে সম্পত্তি হস্তান্তরের জন্য হেবা দলিল একটি জনপ্রিয় ও সাশ্রয়ী মাধ্যম।
এই আর্টিকেলে আমরা হেবা দলিল কী, এর অপরিহার্য শর্তাবলী, রেজিস্ট্রি করার নিয়ম এবং আইনগত দিকগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
হেবা দলিল কি?
হেবা একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ দান। মুসলিম আইন অনুযায়ী, যখন কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান ব্যক্তি কোনো বিনিময় ছাড়া তার সম্পত্তির মালিকানা তাৎক্ষণিকভাবে অন্য কোনো ব্যক্তিকে হস্তান্তর করেন এবং গ্রহীতা সেই দান গ্রহণ করে সম্পত্তির দখল বুঝে নেন, তখন তাকে হেবা বলে। এই প্রক্রিয়াটি যে দলিলের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়, তাকে হেবা দলিল বা দানপত্র দলিল বলা হয়।
জেনে নিনঃ জমির দলিল কি?
কাদের মধ্যে হেবা করা যায়?
রক্তের সম্পর্কের নিকটাত্মীয়দের মধ্যে হেবা করা হলে রেজিস্ট্রি খরচে বিশেষ সুবিধা পাওয়া যায়। এই সম্পর্কের বাইরেও হেবা করা যায়, তবে সেক্ষেত্রে খরচ সাফ কবলা দলিলের মতোই হয়। নিকটাত্মীয়দের মধ্যে রয়েছেন:
- স্বামী ও স্ত্রী
- বাবা-মা ও সন্তান
- দাদা-দাদি, নানা-নানি এবং তাদের সাথে নাতি-নাতনি
- আপন ভাই-বোন
একটি বৈধ হেবার অপরিহার্য শর্তাবলী
মুসলিম আইন অনুযায়ী, একটি হেবাকে আইনগতভাবে বৈধ হতে হলে অবশ্যই তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে:
- দাতা কর্তৃক দানের ঘোষণা (Declaration): দাতা কোনো প্রকার চাপ বা প্রভাব ছাড়া স্বেচ্ছায় তার সম্পত্তি দান করার সুস্পষ্ট ঘোষণা দেবেন।
- গ্রহীতা কর্তৃক দান গ্রহণ (Acceptance): গ্রহীতা বা তার পক্ষ থেকে অভিভাবক (যদি গ্রহীতা নাবালক হয়) সেই দান গ্রহণ করবেন।
- সম্পত্তির দখল হস্তান্তর (Delivery of Possession): দাতা সম্পত্তির দখল গ্রহীতাকে বুঝিয়ে দেবেন। এটি একটি হেবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। দখল হস্তান্তর না হলে সেই হেবা আইনত সিদ্ধ হয় না।
এই তিনটি শর্ত পূরণ হলেই একটি হেবা সম্পন্ন হয়। তবে মালিকানা চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য দলিলটি রেজিস্ট্রি করা বাধ্যতামূলক।
ইসলামী আইনে হেবা দলিলের অবস্থান
- কোরআন ও হাদিসে হেবা করার অনুমোদন আছে।
- হেবা হলো সদকা ও উপহারের একটি ধরন।
- ইসলামী ফিকহ অনুসারে তিনটি শর্ত পূরণ করলে হেবা বৈধ হয়:
- দাতা (Donor) সম্পূর্ণ মালিক হতে হবে।
- দানগ্রহীতা (Donee) উপহার গ্রহণ করতে হবে।
- দানকৃত সম্পত্তি বাস্তবে হস্তান্তর করতে হবে।
বাংলাদেশে হেবা দলিলের আইনগত বৈধতা
- মুসলিম পারিবারিক আইন ও সম্পত্তি আইন অনুযায়ী হেবা বৈধ।
- Registration Act 1908 অনুযায়ী স্থাবর সম্পত্তি (জমি, বাড়ি) হেবা করলে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক।
- দলিল নিবন্ধন না করলে ভবিষ্যতে মালিকানা নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হতে পারে।
হেবা দলিল রেজিস্ট্রি করার প্রক্রিয়া
হেবা দলিল অবশ্যই রেজিস্ট্রি করতে হবে। রেজিস্ট্রেশন ছাড়া এর কোনো আইনগত ভিত্তি নেই।
প্রক্রিয়া:
- দলিল প্রস্তুত: একজন আইনজীবীর সাহায্যে হেবা দলিলের খসড়া তৈরি করতে হবে, যেখানে উপরে উল্লিখিত তিনটি শর্তের বিবরণ স্পষ্টভাবে লেখা থাকবে।
- সরকারি ফি প্রদান: নিকটাত্মীয়দের মধ্যে সম্পাদিত হেবা দলিলের জন্য সরকারি রেজিস্ট্রি খরচ খুবই কম। সাধারণত স্ট্যাম্প শুল্ক, রেজিস্ট্রেশন ফি ও অন্যান্য কর মিলিয়ে নামমাত্র একটি ফি প্রদান করতে হয়।
- রেজিস্ট্রেশন: প্রস্তুতকৃত দলিল এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ দাতা, গ্রহীতা ও সাক্ষীদের সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে উপস্থিত হয়ে দলিলটি রেজিস্ট্রি করতে হবে।
হেবা দলিলের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
- দাতার জাতীয় পরিচয়পত্র (NID)
- দানগ্রহীতার জাতীয় পরিচয়পত্র
- খতিয়ান / দাখিলা / জমির কাগজ
- পাসপোর্ট সাইজ ছবি
- দলিল লেখকের সনদ
- রেজিস্ট্রেশন ফি ও স্ট্যাম্প
হেবা দলিলের খরচ
- রেজিস্ট্রেশন ফি (জমির মূল্যের নির্দিষ্ট অংশ অনুযায়ী)
- দলিল লেখকের ফি
- মিউটেশন খরচ
- কোর্ট ফি (যদি মামলায় যাচাই হয়)
হেবা দলিল কি বাতিল করা যায়?
সাধারণত, একবার হেবার তিনটি শর্ত (ঘোষণা, গ্রহণ ও দখল হস্তান্তর) পূরণ হয়ে গেলে এবং দলিল রেজিস্ট্রি হয়ে গেলে তা আর বাতিল করা যায় না। তবে কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে আদালতে হেবা বাতিলের জন্য মামলা করা যেতে পারে, যেমন:
- প্রতারণা বা জালিয়াতির মাধ্যমে হেবা সম্পাদন করা হলে।
- দাতা কর্তৃক গ্রহীতাকে সম্পত্তি বুঝিয়ে দেওয়ার আগেই যদি দাতা হেবাটি বাতিল করতে চান।
উপসংহার
হেবা দলিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক ও আইনগত প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সম্পত্তি জীবদ্দশায়ই উপহার দেওয়া যায়। এটি শুধু ধর্মীয় দিক থেকেই নয়, আইনগতভাবেও স্বীকৃত। তবে সঠিক প্রক্রিয়া, রেজিস্ট্রেশন ও মিউটেশন না করলে ভবিষ্যতে সম্পত্তি সংক্রান্ত জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শ নিয়ে যথাযথ নিয়মে হেবা দলিল সম্পাদন করা উচিত।
সাধারণ জিজ্ঞাসাসমূহ (FAQs)
১. হিন্দু ধর্মে কি হেবা করা যায়?
উত্তরঃ হিন্দু আইনে দানকে “দানপত্র” বলা হয় এবং এর নিয়মাবলী মুসলিম আইনের হেবা থেকে ভিন্ন। তবে দান করার ধারণাটি উভয় আইনেই স্বীকৃত।
২. হেবা করা সম্পত্তি কি বিক্রি করা যায়?
উত্তরঃ হ্যাঁ, গ্রহীতা হেবা দলিলের মাধ্যমে সম্পত্তির পূর্ণাঙ্গ মালিকানা লাভ করেন এবং তিনি সেই সম্পত্তি বিক্রি, হস্তান্তর বা যেকোনোভাবে ব্যবহারের অধিকার রাখেন।
৩. বাবা কি তার সব সম্পত্তি এক সন্তানকে হেবা করতে পারেন?
উত্তরঃ হ্যাঁ, মুসলিম আইন অনুযায়ী একজন ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় তার সকল সম্পত্তি যেকোনো এক বা একাধিক সন্তানকে হেবা করে দিতে পারেন। এতে আইনগত কোনো বাধা নেই।