জমিজমা কেনা-বেচার ক্ষেত্রে যে নামটি সবচেয়ে বেশি শোনা যায়, তা হলো “সাফ কবলা দলিল”। সম্পত্তির মালিকানা হস্তান্তরের এটিই সর্বাধিক প্রচলিত এবং আইনগতভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। আপনি যদি জমি বা ফ্ল্যাট কেনার পরিকল্পনা করে থাকেন, তবে সাফ কবলা দলিল সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা আপনার জন্য অপরিহার্য।
এই আর্টিকেলে আমরা সাফ কবলা দলিল কী, এটি রেজিস্ট্রি করার ধাপে ধাপে প্রক্রিয়া, সম্ভাব্য খরচ এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
সাফ কবলা দলিল কী?
সাফ কবলা দলিল (Sale Deed) হলো এমন একটি আইনি নথি যার মাধ্যমে বিক্রেতা একটি নির্দিষ্ট মূল্যের (পণ) বিনিময়ে কোনো স্থাবর সম্পত্তির (জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট ইত্যাদি) মালিকানা ক্রেতার কাছে স্থায়ীভাবে হস্তান্তর করেন। রেজিস্ট্রি হওয়ার পর এই দলিলের মাধ্যমে ক্রেতা সম্পত্তির উপর নিরঙ্কুশ মালিকানা ও ভোগ-দখলের অধিকার লাভ করেন।
এটি একটি চূড়ান্ত দলিল; এর পরে সাধারণত আর কোনো দলিলের প্রয়োজন হয় না (যদি না দলিলে কোনো ভুল থাকে)।
জেনে নিনঃ জমির দলিল কি?
সাফ কবলা দলিল রেজিস্ট্রি করার প্রক্রিয়া (ধাপে ধাপে)
একটি নির্ভুল সাফ কবলা দলিল রেজিস্ট্রেশনের জন্য নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করা অত্যন্ত জরুরি:
ধাপ ১: সম্পত্তির মালিকানা যাচাই দলিল করার আগে ক্রেতাকে বিক্রেতার মালিকানা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। এর জন্য যা যা যাচাই করতে হবে:
- বিক্রেতার নামে থাকা সর্বশেষ খতিয়ান (CS, SA, RS, BS/City Jorip)।
- নামজারি (Mutation) ও হালনাগাদ ভূমি উন্নয়ন করের রশিদ।
- বিক্রেতা যে দলিলবলে মালিক হয়েছেন, সেই মূল দলিল (ভায়া দলিল) ও মালিকানার ধারাবাহিকতা।
- সম্পত্তিটি কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে দায়বদ্ধ (Mortgage) কিনা।
ধাপ ২: দলিলের মুসাবিদা (Drafting) একজন অভিজ্ঞ দলিল লেখক বা আইনজীবীর মাধ্যমে দলিলের খসড়া তৈরি করুন। দলিলে যা যা উল্লেখ থাকতে হবে:
- ক্রেতা ও বিক্রেতার পূর্ণাঙ্গ নাম, ঠিকানা ও পরিচয়।
- সম্পত্তির তফসিল (জেলা, উপজেলা, মৌজা, খতিয়ান নম্বর, দাগ নম্বর, জমির পরিমাণ, চৌহদ্দি)।
- সম্পত্তির মোট মূল্য (পণ) এবং পরিশোধিত অর্থের বিবরণ।
- মালিকানার ধারাবাহিকতার বর্ণনা।
ধাপ ৩: সরকারি ফি ও কর পরিশোধ দলিল রেজিস্ট্রির জন্য সরকার নির্ধারিত ফি ও কর ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করে পে-অর্ডার সংগ্রহ করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে:
- স্ট্যাম্প শুল্ক (Stamp Duty)
- রেজিস্ট্রেশন ফি (Registration Fee)
- উৎস কর (Source Tax)
- স্থানীয় সরকার কর (Local Government Tax)
- মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট (VAT – প্রযোজ্য ক্ষেত্রে)
ধাপ ৪: সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে সম্পাদন নির্ধারিত দিনে ক্রেতা, বিক্রেতা, সাক্ষীগণ এবং শনাক্তকারীকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে উপস্থিত হতে হবে। সাব-রেজিস্ট্রারের সামনে সবাই দলিলে স্বাক্ষর করবেন এবং ছবি ও আঙুলের ছাপ প্রদান করবেন।
সাফ কবলা দলিলের রেজিস্ট্রি খরচ
দলিলের রেজিস্ট্রি খরচ কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে, যেমন সম্পত্তির অবস্থান (সিটি কর্পোরেশন/পৌরসভা/ইউনিয়ন) ও সম্পত্তির মূল্য। খরচের হার সরকার কর্তৃক সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হয়। সাধারণত, সম্পত্তির মোট মূল্যের উপর ৮% থেকে ১০% পর্যন্ত খরচ হতে পারে।
সম্পূর্ণ খরচের তালিকা দেখতে আমাদের এই আর্টিকেলটি পড়ুন: [লিংক টু রেজিস্ট্রি খরচের বিস্তারিত আর্টিকেল]
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র (চেকলিস্ট)
- বিক্রেতার জন্য:
- জাতীয় পরিচয়পত্রের (NID) কপি।
- মালিকানার প্রমাণ হিসেবে খতিয়ান ও দলিলের মূল কপি।
- হালনাগাদ ভূমি উন্নয়ন করের রশিদ।
- নামজারি খতিয়ানের কপি।
- পাসপোর্ট সাইজের ছবি।
- ক্রেতার জন্য:
- জাতীয় পরিচয়পত্রের (NID) কপি।
- পাসপোর্ট সাইজের ছবি।
- ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (TIN) সার্টিফিকেট (বাধ্যতামূলক)।
- অন্যান্য:
- সাক্ষী ও শনাক্তকারীর জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি।
- সরকারি ফি জমা দেওয়ার পে-অর্ডারের মূল কপি।
সাধারণ জিজ্ঞাসাসমূহ (FAQs)
১. সাফ কবলা দলিল কি বাতিল করা যায়?
উত্তরঃ সাধারণত রেজিস্ট্রিকৃত সাফ কবলা দলিল বাতিল করা যায় না। তবে প্রতারণা বা জালিয়াতির প্রমাণ সাপেক্ষে আদালতে মামলা করে দলিল বাতিলের আবেদন করা যেতে পারে, যা একটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া।
২. বিক্রেতা দলিল রেজিস্ট্রি করে দিতে না চাইলে করণীয় কী?
উত্তরঃ বায়নাপত্র দলিল করা থাকলে, সেই দলিলের শর্ত অনুযায়ী আপনি আদালতে “চুক্তি প্রবলের” মামলা করে রেজিস্ট্রি সম্পন্ন করার জন্য আবেদন করতে পারেন.